যমুনা মরে গেছে সেই কবে! এর রূপ এখন ভীষণ বিবর্ণ। ধুধু বালুচর যত দূর চোখ যায়। স্রোতস্বিনী বহু দূরে, অতি ক্ষীণকায়া। বেড়িবাঁধ ধরে এগুতে থাকি। সেই কাকডাকা ভোরে বেরিয়েছি। হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গা বেয়ে খাড়া পাড় নেমে গেছে নদীর তলদেশে। আগামী বার এ স্কুল থাকবে না, নিশ্চিত। আগেও গেছিল দু’বার যমুনার গর্ভে। বসতবাড়ির চালা, গোয়ালের গরু আর নারী-শিশুদের সাথে স্কুলটাও এতদূর বয়ে এনেছে বাস্তুহীন মানুষ। এবার কোথায় নেবে কে জানে!
বাঁধ উত্তরে চৌহালী উপজেলা পরিষদের পুরানো ক্যাম্পোসের দিকে ভারী কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেছে। প্রমত্তা যমুনা শাসনের জন্য একদা নির্মাণ করা হয়েছিল এ বাঁধ। আজ নদীভাঙা ভুখা মানুষের খুপড়ি ঘর আর গরু-ছাগলের দেদার দখলে এর দু’পাশ।
নভেম্বর শেষ হতে চলল। এদিকে ভাল ঠাণ্ডা পড়েছে। উঁচু বাঁধের উপর আখের শুকনো পাতার আগুনে ওম পাবার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বুড়োরা। আর মোটা জাম্পারে মিথ্যে উষ্ণতা খুঁজতে ব্যস্ত শিশুদের চোট্ট নাক দিয়ে শিন্ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বাঁধের মধ্যিখান দিয়ে ‘পায়ে চলা’র রাস্তা। ঘাস-লতাপাতায় মাখা শিশির ভিজিয়ে দিচ্ছে দু’পা। বাঁধের দু’ধারে খুপড়িগুলোর পেছনে লাউ-কুমড়োর মাচান। চারদিক গাঢ় সবুজ জমিনে হলুদ-সাদা ফুলের ক্যানভাস। ধুসর কুয়াশামাখা মায়াময় এ গ্রামের নাম ‘পয়লা’।
হাঁটতে হাঁটতে পুরানো উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে আমাদের দ্বিতল পল্লীভবনের সামনে এসে দাঁড়াই। অনেক বছর আগে ক’মাসের জন্য এ উপজেলা দপ্তরের দায়িত্বে ছিলাম। অতিরিক্ত দায়িত্ব। বেলকুচি থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সেই মহাযমুনা পাড়ি দিয়ে মাঝে মধ্যে এখানে আসতে হতো। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ছিল একমাত্র বাহন। একবার নদীর মাঝখানে এমন ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম, ভাবলে এখনো শিউরে উঠি। সুতরাং খুব যে আপন করে নিতে পেরেছিলাম এ দপ্তরকে, তা হলফ করে বলতে পারছি না।
উপজেলা পরিষদের প্রায় সবটুকুই নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। আমাদের পল্লীভবনের কোণা নদীর খাড়া পাড়ে মরার মত ঝুলছে। নিচতলার যে কক্ষে আমি বসতাম, তার বাইরে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তার মলিন নামফলক। দরজার একটি পাল্লা কেউ ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। মেঝের প্লাস্টার ফেটে গুল্ম-লতা গজিয়েছে। আবর্জনা আর পোকামাকড়ের বসতি পুরো ভবন জুড়ে। দু’বার টেন্ডার হয়েছে। পার্টি নেই। হয়তো একসময় জলের দরে বিকিয়ে যাবে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে।
বাঁধ থেকে ঢালুতে নেমে পড়ি। উঁচু পাড় কেটে কেটে তৈরী হয়েছে নেমে যাওযার সিঁড়ি। ভীষণ পিচ্ছিল। দু’পাশে বাঁশবাগান। অশ্রুবিন্দুর মত জলের ফোঁটা বাঁশের পাতার চোখা ডগা গলে গলে নেমে আসছে গালে। চোখের সামনে যতদূর চোখ যায়, যমুনা।
চরের বালিয়ারি ভেজা ভেজা। এদিকে অনেক মানুষের সমাগম। সারি সারি ষাঁড় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্ধত শিংয়ে রঙিন জরির মালা। গলায় বাঁধা দড়ি শক্ত পেশির পুরুষের হাতে। তাদের অনুসরণ করছে দ্রুতগামী মলিন খালি পা নারী ও শিশু।
এক সময় জলের ধারে নদীর ঘাটে পৌঁছি। কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে এখানে! অগণিত মানুষ। পুরুষ, নারী ও শিশু। আর অসংখ্য ষাঁড়। কী বিচিত্র! কী অপরূপ! বড় বড় নৌকা ঘাটে বাঁধা। তাতে উঠার জন্য বাঁশের মাচান। ষাড়ের সাথে শক্তির কসরতে ব্যস্ত শক্ত পেশির পুরুষেরা। একজন কিছুতেই নৌকায় উঠবে না, আরেকজন নাছোর। চূড়ান্ত বিচারে পুরুষের অনিবার্য জয়।
মাথার পেছনে দু’হাত ঠেলে ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নারী। ছলছল চোখ। গত ছ’মাস শোবার ঘরে স্বামীর মাচানের পাশে শুয়ে জাবর কেটেছে সে। সকালের পান্তা স্বামীকে না খাইয়ে কুড়া-বিছালির সাথে তাকে খাইয়েছে। মহাজনের ঋণের তিশ হাজার এখনো সুদে আসলে বাড়ছে। কত স্মৃতি! কত স্বপ্ন! আসছে কুরবানির হাটে গাবতলীতে উঁচু দরে বিকোবে সে। ঋণ শোধ হবে। বছরের চাল-ডাল-স্বপ্ন কেনা হবে সে টাকায়।
জলের তোড়ে ঝাপসা হয়ে আসা কালো দু’চোখ নৌকায় ঠিক কাকে খুঁজে ফিরে! স্বামীকে, নাকি ষাঁড়কে! বিদায় জানাতে হবে। অনেক দূরে, আরিচা হয়ে গাবতলীর পথে রওনা হচ্ছে সে। বিদায় জানানোর জন্যই তো এই সব আয়োজন।