‘তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছো, মূল মন্দির চত্ত্বরে প্রবেশের মুখেই কয়েকটি ছোট আকারের মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে আইসিসকে উৎসর্গীকৃত মন্দিরটির মূল কাঠামো ও থামগুলো দৃশ্যমান আছে। একটি মন্দির দেবতা হোথরকে উৎসর্গীকৃত। মূল কমপ্লেক্সের ভেতরের দিকে দুটি চেম্বারের দেয়াল নানান কাল্পনিক ও সাঙ্কেতিক শিল্পকর্মে পরিপূর্ণ। অবশ্য পুরো কমপ্লেক্সের সকল দেয়ালগাত্রই আইসিস-ওজাইরিসের খোদাই শিল্পকর্মে ভরা। কিন্তু হোরাসের খোদাইকর্মগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় অবিকৃতই রয়ে গেছে। তোমরা লক্ষ্য করেছো কি?’
আমি জেসিকার চোখে তাকাই। ফাতমার দিকেও। না, আমরা কেউ লক্ষ্য করিনি তো! টেম্পলের প্রতিটি দেয়ালের প্রতি ইঞ্চি স্থান মিশরীয় মিথলজির হাজারো সাঙ্কেতিক ভাষা, প্রতীক, ছবি আর কাহিনীতে পূর্ণ। কোন শূন্য স্থান নেই। আজকের আগে অবধি আইসিস, ওজাইরিস, হোরাস, আনুবিস, হোথর, সেথ, নেপথিস, থোথ কিংবা গেব, রা কাকেই বা চিনতাম আমি! কারই বা নাম শুনেছি!
বৃদ্ধ বলে চলে, ‘আইসিসের ক্রোড়ে দুগ্ধ পানরত শিশু হোরাসের খোদাইকর্মগুলো তোমরা ভাল করে লক্ষ্য করো। কী চিরন্তন! কী সত্যি! মমতাময়ী মায়ের বুকে শিশুপুত্র দুগ্ধপানরত। এ তো শিশু যীশু, মাতা মেরির ক্রোড়ে, দুগ্ধ পান করছে! বাইজেন্টাইন বাহিনী এই চিত্রকর্মগুলোকে অস্বীকার করবে কি করে? তারা তো খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছিল। সুতরাং তারা ভুল বুঝে, ভুল বিশ্বাসে আইসিসের বুকে শিশু হোরাসকে রক্ষা করেছে, মাতা মেরির ক্রোড়ে শিশু যীশু ভেবে।
‘সুতরাং যে কারণে টেম্পলের অন্যান্য খোদাইকর্ম তারা আঘাত করে, খুঁচিয়ে, খুঁটিয়ে ধ্বংস করেছে, সেই একই কারণে শিশু হোরাস-মাতা আইসিসের খোদাইকর্মগুলো তারা রক্ষা করতে চেয়েছে।
‘তরুণ হোরাস বীর বিক্রম হয়ে ওঠে। মা আইসিসের আশীষ তার সাথে। পিতা ওজাইরিসের প্রতিষ্ঠিত স্বর্গরাজ্য মিশরের সিংহাসন ফিরে পেতে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। চাচা সেথের সাথে অনিবার্যভাবে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় সে। কিন্তু সেথের কুটকৌশলে বার বার হারতে থাকে। মা আইসিস সন্তান হোরাসকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সে সেথকে ধারালো টেঁটা দিয়ে আক্রমণ করে। কিন্তু সেথ উল্টো আইসিসকেই আঘাত করে বসে। ধারালো মেইসের আঘাতে আইসিসের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দেবতা থোথ কাটা মাথার স্থানে গরুর মাথা স্থাপন করে আইসিসকে সে যাত্রায় রক্ষা করে। এ কারণে তোমরা মিশরীয় বিভিন্ন মন্দির গাত্রে চিত্রকলায় গরুর মাথাওয়ালা আইসিসকে হামেশাই দেখতে পাবে।
‘সিংহাসনের দাবিতে শেষ পর্যন্ত দেবতাদের আদালতে মামলা ঠুকে দেয় হোরাস। বিচারক অবশ্যই তার দাদা ঈশ্বর গেব। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির দেবতা এতুম বেঞ্চের সদস্য। দেবতা থোথ দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। পৃথিবীর আদালতের মতই স্বর্গীয় এ মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলে। তুমুল তর্কবিতর্ক ও যুক্তি খণ্ডন হয়। শেষ পর্যন্ত বিচার-বেঞ্চ সমস্যা সমাধানের জন্য ওজাইরিসকে পত্র লিখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ ওজাইরিস পুতপবিত্র। সে কেবল পরজীবনের ঈশ্বরই নয়, বরং মৃত্যু, রূপান্তর ও পুনর্জীবনেরও ঈশ্বর। সুতরাং সে-ই সত্যিকারের ন্যায়বিচারক।
ওজাইরিস তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে, অসৎ উপায়ে ক্ষমতা দখল কখনো বৈধ হতে পারে না। অথচ সেথ তাই করেছে। হোরাস কাউকে হত্যা করেনি। সুতরাং হোরাসই যোগ্য শাসক। দেবতাদের আদালত ওজাইরিসের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়। হোরাস মিশরের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
‘দেবতা ওজাইরিস ও দেবী আইসিসের সন্তান বীর হোরাস আনুষ্ঠানিকভাবে মিশরের সিংহাসন লাভ করে। সুতরাং সে ঈশ্বর মনোনীত রাজা। পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রথম মানব-শাসকও বটে। সে ম্যান-গড। মিশরের প্রথম ফারাও বা ফেরাউন।’
চার পর্বে সমাপ্ত ই-বুক
পূর্বের তিন পর্ব পড়ুন:
সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)