১২০ বছরের পুরাতন, পরিত্যাক্ত এক রেলওয়ে টানেলকে স্থানীয় কৃষকরা ওয়াইন টানেলে রুপান্তর করেন। এ ভ্রমণ গল্পে সেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সৌন্দর্য্য এবং সেখানে বসে এক পেয়ালা পারসিমন ওয়াইন চেখে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।

Share on social media

মাউন্টেইনের তলে পরিত্যাক্ত দীর্ঘ রেলওয়ে টানেলের গভীরে ঢুকে উষ্ণতা ফিরে পাই। কোরিয়ায় বসন্ত এসে গেছে, শুভ্র চেরির স্নিগ্ধতা চারদিকে। দক্ষিণের দিকে এর প্রকাশ আরো মাদকতাময়। সিউল থেকে বাসে চার ঘন্টার পথ পেরিয়ে ছিয়ংদো এসেছি এই মাদকতায় ভাসবো বলে। বসন্তের হিম বাতাস আর ঝড়ো বৃষ্টির জ্বালাতন সইতে সইতে শহর ছেড়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছি। নিটোল কোরিয়ান গ্রামীণ জীবন এদিকে। চারদিকে মাউন্টেইনের ভাঁজে ভাঁজে পেঁজা তুলোর মতোন মেঘ। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে।

আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে বাস এগুতে থাকে। বৃষ্টির ছাঁটে ছাঁটে ঘোলা হয়ে আসে জানালার কাচ। জ্যাকেটের হাতায় ঘষে ঘষে স্বচ্ছতা ফেরাতে চেষ্টা করি। প্রকৃতির এই নিটোল রূপ সত্যিই অপার্থিব।

টানেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে পার্কিং। লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। বৃষ্টি মাথায় দৌড়ে এক দোকানির ছাউনিতে আশ্রয় নিই। পারসিমন ফলের শুকনো, আধ-শুকনো আচারের প্যাকেট, ভিনেগার বোতল ইকসু, আর ওয়াইন। থরে থরে সাজানো। মধ্যবয়সী দোকানি ফ্রি আচার দিয়ে আপ্যায়ন করে। আশেপাশে এমন আরো দোকানরাজি। সবত্র বুড়ি মহিলাদের রাজত্ব। ফ্রি পারসিমন খাওয়ানোর উদ্দেশ্য ব্যাখা করে আমাদের সুন্দরী কোঅর্ডিনেটর ইয়ুনহি কুয়াক। ফেরার সময় এই আন্টির দোকান থেকেই যেন কয়েকটা বোতল কিনে নিয়ে যাই আরকি! পাগল!

১২০ বছরের পুরানো টানেল: অপার বিস্ময়

টানেল এখান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। দু’ধারে বৃষ্টিস্নাত গোলাপি-সাদা চেরির সারি। কোরিয়ান ট্র্যাডিশনাল বাড়িঘর, হ্যানক। সৌন্দর্য্য যেন চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। টালিনির্মিত বাঁকানো চালগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে চকচক করছে। সারি সারি রেস্টুরেন্ট। বাইরে ভেজা চপচপে কাঠের বেঞ্চ। সব শূন্য। এখন ট্যুরিস্ট সিজন নয়। উপরন্তু ঠাণ্ডা, আর বৃষ্টি।

পারসিমন আচার চাখতে চাখতে একসময় টানেলের সামনে পৌঁছে যাই। রেল লাইন ঢুকে গেছে মাউন্টেইনের গহ্বরে। মুখে কাঠের তৈরি ভারি গেট। খোলা পকেটটুকু দিয়ে সোনালি আলোর মেলা চোখে পড়ে। এই ছিয়ংদোর ওয়াইন টানেল।

ভেতরে ঢুকে থ বনে যাই। সত্যিই আলোর মেলা! টানেলের একপাশের দেয়াল ঘেঁষে পায়ে চলার সরু পথ। অপর পাশে সারি সারি দোকান। সব ওয়াইনের। মায়াবি আলোয় ভরা চারদিক। পরিত্যাক্ত টানেলের ভারী গ্রানাইট ব্লক আর লাল ইট ঢেকে রাখার চেষ্টাই করা হয়নি। পাথরের গা বেয়ে কোথাও কোথাও পানি চুঁইয়ে পড়ছে। দোকানগুলোর পাশে সারিবদ্ধ বসার জায়গা। হাই-বেঞ্চ লো-বেঞ্চ।। এন্টিক সব। আমি কোরিয়ার বিখ্যাত এবং সম্ভবত, পৃথিবীর একমাত্র ওয়াইন টানেলের ভেতরে একটা বেঞ্চের কোনা দখল করে বসে পড়ি।

কিভাবে তৈরি হলো ওয়াইন টানেল

জেসন ডাইনেস্টির আমলে মাউন্টেইন খুদে এ টানেল তৈরি। ছয় বছরের নির্মাণ কাজ শেষে ১৯০৪ সনে এতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তারপর প্রকৃতির নিয়মে একসময় অকেজো হয়ে পড়ে। পরিত্যাক্ত পড়ে থাকে অনেক বছর। স্থানীয় কৃষক পরিবারগুলো নির্জন টানেলের ভেতরে পারসিমন গ্যাঁজানো শুরু করে। টানেলের ন্যাচারাল তাপমাত্রা এ কাজের জন্য সবসময় যুতসই ছিল। সর্বদা ১৫ সেলসিয়াস। বাতাসের আদ্রতা সারা বছরই ৬০-৭০% এর মধ্যে। আস্তে আস্তে কৃষকদের কাছে এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।

অবশেষে ২০০৬ সনে কিছু সংস্কার শেষে স্থানীয় কমিউনিটির উদ্যোগে এটি ওয়াইন টানেল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তারপর কোরিয়ার ট্যুরিস্ট মানচিত্রে সোনালি মুকুটের স্বীকৃতি পেতে এর সময় লাগেনি মোটেও।

পারসিমন ফল এবং ওয়াইন

পারসিমন কোরিয়ার জাতীয় ফল। সাধারণের অত্যন্ত জনপ্রিয়। ছিয়ংদো এলাকায় বেশি ফলে। শরতের শেষে রসে ভরপুর পাকা হলুদ পারসিমন স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। ভিটামিন এ আর সি সমৃদ্ধ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এ ফল ব্রঙ্কাইটিস, ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপের অসুখে ভাল কাজ দেয়। ত্বকের জন্যও ভাল। এমনকি, ক্যান্সারেও নাকি উপকারী। সে যাই হোক, বর্তমানে পারসিমন শিল্প স্থানীয় কৃষক পরিবারগুলোর রুটি-রুজির যোগান দিচ্ছে, এটাই বড় কথা।

বলা বাহুল্য, পারসিমন ওয়াইন সমগ্র কোরিয়াতে ভীষণভাবে আদৃত। চিজ আর চকোলেটের সাথে এক পেয়ালা পারসিমনের স্বাদ অপার্থিব; শুনে এসেছি। বাঙালের আবার ওয়াইনের স্বাদ! মাইক্রো-সাইজের কাচের পেয়ালা ভর্তি ওয়াইন চলে আসে আমাদের সামনে। কম্পমান দু’আঙুলের চাপে আলতো তুলে নিই একটা পেয়ালা এবং চোখ বন্ধ করে চুমুক দিই। ছেলেবেলায় গ্রীষ্মের তাপদাহে মাঠের ধারে তালের একগ্লাস ঝাঁঝালো রসের যে স্বাদ, এ তো সেই জিনিস! কী জানি, বেশি বলা হয়ে গেল কি না!

কোরিয়ার অন্যতম ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন

টানেল এক কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি দীর্ঘ। চওড়া সাড়ে চার মিটার। আর উঁচু সাড়ে পাঁচ। এর মধ্যে দেড় লাখের মত বোতল রয়েছে। পাথরের গায়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা। বোতলের পাছায় মায়াবি আলোর বিচ্ছুরণ। পায়ে চলার পথে রঙিন ফুলের সারি। ডেটিংয়ের জন্য সত্যিই স্বর্গ। জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতি মুখোমুখি ঝুঁকে নিচু স্বরে কথা বলছে। হাতে পারসিমনের পেয়ালা। টেবিলে চিজ আর চকোলেট। কোঅর্ডিনেটর ইয়ুনহি কুয়াক জানায়, সামারে এখানে ভীষণ ভিড় হয়। তখন বাইরে রোদে চামড়া পুড়লেও এর ভেতরের তাপমাত্রা বিস্ময়করভাবে ঠাণ্ডা। ন্যাচারাল এয়ারকুলার। সেই এনভায়রনমেন্ট উপভোগ করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই এখানে বেড়াতে আসে। ট্যুরিস্টের ঢল নামে তখন।

এক লক্ষ বোতল ওয়াইন

টানেলের ভেতরে ওয়াইন স্টোরেজের নানা আয়োজন চোখে পড়ে। বোতল তো রয়েছেই, ওয়াইন পিপাও। প্রথম পিপা দেখছি। কী বিশাল সাইজ এক একটার! সিল করা। ফারমেন্টেশন চলছে।

স্টোরেজ আর ক্যাফে ছাড়াও ট্যুরিস্টদের বিনোদনের জন্য ভেতরের বড় একটা অংশ জুড়ে আর্ট গ্যালারি করা হয়েছে। ছোট্ট কাগজের টুকরোয় নিজের কোন গোপন ইচ্ছের কথা লিখে গ্যালারির দেয়ালে ঝুলিয়ে দাও। কাগজের ডিজাইনও ওয়াইন বোতলের। রঙ সাদা আর সোনালি। অপূর্ব! এক কোটির মত কাগজ-বোতল গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে। বেশিও হতে পারে। কে আর গুণে দেখেছে!

সুন্দরী কুয়াক আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন; ভারী ট্রাইপড হাতে বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছি। তাকে খুশি করার জন্য বলি, কুয়াক, বিশ্বাস করো, ফটোগ্রাফির জন্য এই টানেল একটা সত্যিকারের স্বর্গ। আমি এর মধ্যে হারিয়ে গেলে দুঃখিত হবো না মোটেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

হ্যানক গাঁয়ের রঙ

কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.