সিউলে কোরিয়ান লোকনাট্যপালা দেখার অসাধারণ অভিজ্ঞতার গল্প। সঙ্গীত, রিদম, গতি, সোর্ডড্যান্স আর কোরিয়ান সমাজের অন্তর্নিহিত দর্শনের সম্মিলিত মহাআয়োজন। থিয়েটার নয়, যেন সিনেমা।

Share on social media

জিয়নডং থিয়েটারের হলরুম থেকে বেরিয়ে প্রশস্ত করিডোরের এক পাশে আশ্রয় নিই। রাজধানী সিউলে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে আগেই। গত দেড় ঘণ্টা কোন ফাঁকে পেরিয়ে গেছে বুঝিনি। মাথার মধ্যে কোরিয়ান ট্র্যাডিশনাল ড্রামের প্রচণ্ড বিট, লোকসংগীতের মুর্ছনা আর সোর্ড-ড্যান্সের ঝলকানি। ঠিক হতে সময় লাগবে বুঝতে পারছি।

ওপাশে পারফর্মাররা ক্ষুদে দর্শকদের সাথে ফটোসেশনে ব্যস্ত। আমি নাট্যপালার নির্দেশককে খুঁজতে থাকি। ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়। পরনে কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক হানবুকের আধুনিক ফিউশন। নিজে এসে আমাকে নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। মাথা নুয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন। শো চলাকালীন দর্শকদের একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে পারফর্মারদের গাইড করছিলেন, দেখেছি। এমন অসাধারণ নাট্যআয়োজনের জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য জ্ঞান করছি।

ক’দিন হলো এই সিটিতে এসেছি। এরই মধ্যে থিয়েটার দেখার আয়োজন। ভাষা জানি না, সংস্কৃতি বুঝি না, মানুষ চিনি না। সুতরাং ভাল কিছুর প্রত্যাশা একেবারেই ছিল না।

জিয়নডং অডিটোরিয়াম আমাদের মহিলা সমিতির মতই। মোটের উপর শ’তিনেক আসন। হাউস ফুল। বাবা-মায়ের সঙ্গে বাচ্চারাও এসেছে। মুচমুচিয়ে আলুর চিপস খাচ্ছে। মাইক্রোফোনে বার বার ঘোষণা আসছে পারফর্ম্যান্সের কোন ছবি নেয়া যাবে না। পুরো নাট্যপালার কপি-রাইট রয়েছে! কি আর করা, সাধের ক্যামেরা ব্যাগের কোণে রেখে মঞ্চের দিকে মনোনিবেশ করি।

বিস্ময় ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কোরিয়ান ও ইংরেজি ভাষায় ঘোষণা আসে নাট্যপালায় কোন ডায়ালগ নেই। নির্বাক মেলোড্রামা। শিরোনাম ‘লোটাস, অ্যা ফ্লাওয়ার কামস্ আউট ওয়ান্স মোর’। শতদলের পুনর্জন্ম! মঞ্চের একেবারে সামনের দু’কোণে প্রায় জীবন্ত গোটাকতক পদ্মফুল পদ্মপাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে রয়েছে। তীব্র স্পটলাইট তার উপর। কোমল সঙ্গীত বেজে চলেছে। নাট্যপালা শুরু হয়।

কোরিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত জেসন রাজবংশের শাসনকাল। লম্পট রাজা বাইকজে’র রাজসভা। বীর দোদাম’কে নতুন সেনাপতি হিসেবে বরণানুষ্ঠান। রাজা উপস্থিত। রাণী উপস্থিত। সভাসদ উপস্থিত। রাজ্যের সেরা নর্তকী অপরূপা সেয়োরিয়ন পারফর্ম শুরু করে। নৃত্য ও সঙ্গীতের মুর্ছনায় স্বতন্ত্র দ্যোতনা সৃষ্টি করে তার দুই তারের বাদ্যযন্ত্র হেইগিয়ুম। এক তার আনন্দের, আরেক তার কান্নার। তার জীবনেরই সত্যপাঠ যেন।

হঠাৎই লোলুপ রাজার চোখ পড়ে সেয়োরিয়নের উপর, অনিবার্যভাবেই। কিন্তু সে যে সেনাপতি দোদামের প্রণয়ী! সাসপেন্সের সূত্রপাত এখান থেকেই।

হিংসুটে রাণী সেয়োরিয়নকে বনবাসে প্রেরণ করে। দোদাম গভীর জঙ্গলে তাকে খুঁজে পায়। তারপর নিবিড় প্রেমলীলা দু`জনের। একদিন রাজা আসে বনে, শিকার করতে। ধরা পড়ে যায় তারা। ক্রোধন্মত্ত রাজা সেয়োরিয়নকে প্রাসাদে এনে বন্দি করে। ওদিকে দোদাম তার বিশ্বস্ত অনুসারী নিয়ে গোপনে প্রাসাদে প্রবেশ করে। সেয়োরিয়নকে উদ্ধারের অভিপ্রায়ে। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষ হয় অসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে। রাজার তরবারির আঘাতে সুন্দরী সেয়োরিয়ন তার প্রেমাস্পদ দোদামের কোলে মৃত্যুবরণ করে।

সংলাপের প্রয়োজন ছিল না। কোন স্কোপও দেখিনি। কোরিয়ান লোকনৃত্য তাইপিয়ংমু, কনফুসিয়াস রিচুয়্যল `পারিলমু` ও সোর্ডড্যান্স ধারার অসাধারণ আধুনিকী শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থাপনা। সঙ্গে সঙ্গীত, রিদম, গতি, কোরিয়ান সমাজের অন্তর্নিহিত ভাবদর্শন ও প্রচণ্ড আবেগ দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মত মঞ্চে আবিষ্ট করে রাখে। সাথে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহযোগে মঞ্চসজ্জা, ডিজিটাল আলোক প্রক্ষেপণ, সাউন্ড সিস্টেম। নাট্যপালার সাফল্যের অর্ধেক কাজ প্রযুক্তিই করে দেয়। তরুণ পারফর্মারদের কোরিয়ান ট্রাডিশনাল পোশাকও বিশেষভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য।

নাটকের পরের ভাগ আরও নাটকীয়। লোকগল্পের সাথে রূপগল্পের সঙ্গম। মঞ্চে আভির্ভূত হয় তন্ত্রসাধক আরেক নারী, মোহুয়া। কোরিয়ান পুরাণে মোহুয়া জীবনদাত্রী। ঋত্বিক। সাধারণের পূজ্য। কিন্তু নারী বলে তারা শাসকের চোখে অভিশপ্ত। এ পেনিনসুলার জেজু দ্বীপাঞ্চলে মোহুয়ার তন্ত্রসাধনার শক্তিতে মৃতের পুনর্জীবনের গল্প প্রচলিত আছে।

সিয়োরিয়নের জীবন ফেরাতে শুরু হয় তন্ত্রসাধনযজ্ঞ। সে কি তুমুল মঞ্চ পরিবেশনা! মনে হয় যেন আমি জেসন শাসনকালে স্বয়ং উপস্থিত। সিয়োরিয়োনের মৃত্যুবেদির সামনে। শোকে বিহ্বল।

মোহুয়া রিচুয়্যল-নৃত্য করে চলেছে। কোরিয়ান ড্রামের উত্তাল বিট। মঞ্চ জুড়ে অপরূপা রাজকীয় নারীদের শোকনৃত্য। অবশেষে প্রেম ও বিশ্বাসের জয় হয়। নারীর শক্তি ও সংগ্রামের জয় হয়। জেগে উঠে সিয়োরিয়ন।

দূরপ্রাচ্যের মিথলজিতে শতদল পুনর্জন্মের প্রতীক। শত বাধা পেরিয়ে, প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সেই শতদলেরই পুনর্জন্মকথন ‘লোটাস, অ্যা ফ্লাওয়ার কামস্ আউট ওয়ান্স মোর’। মনে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

হ্যানক গাঁয়ের রঙ

কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.