মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Share on social media

‘আইসিস প্রাসাদে নির্ঘুম। অজানা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। হঠাৎ মধ্যরাতের নির্জনতা খান খান করে ভেঙ্গে কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে খাঁচাবন্দি ঈগল। বুক কেঁপে ওঠে আইসিসের। কী হলো! কী হলো ওদিকে! ওজাইরিস! প্রিয়তম ভাই আমার। তুমি কোথায়? ফিরে এসো স্বামী!

‘ততক্ষণে ভারী কফিনের ভেতরে রাজা ওজাইরিসের গগণবিদারী আর্তনাদ আর শোনা যাচ্ছে না। কফিনের লোহার খিলগুলো সিসা গলিয়ে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে সেথের বিশ্বস্ত অনুচররা। তাদের হাতে নাঙ্গা মেইস উদ্ধত। ঘটনার বীভৎসতায় আমন্ত্রিত অতিথিরা দিশেহারা। হায় হায়, এ কী ঘটে গেল! এ কী ঘটে গেল চোখের পলকে!

‘সেথ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। বিশ্বস্ত অনুচরগণ, আমন্ত্রিত অতিথিদের যেন কোনরকম অসম্মান করা না হয়। তোমাদের উপর যেমন নির্দেশনা রয়েছে তা’ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করবে।

হঠাৎ রঙমহলের সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। ভেতরে হাজার ঝাড়বাতির প্রতিফলিত আলোকচ্ছটায় অনুচরদের ধারালো মেইস জ্বলজ্বল করে ওঠে। তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই উপস্থিত সকল অতিথির মস্তিষ্ক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। মহলের লাল মসৃণ গ্রানাইটের মেঝে বেয়ে উষ্ণ রক্তস্রোত দ্রুত নেমে যায় নীল নদের গভীরে।

‘ঘোর অমাবস্যার রাত। গভীর অন্ধকারে ঢাকা ওজারিসের কিংশিপ মিশর। কালো পাথুরে উপত্যকার পথে কাউকে চেনার উপায় নেই। শক্ত গর্দানের আটজন অনুচর কফিন কাঁধে নিঃশব্দে নেমে যেতে থাকে নীলের জলের ধারে। সামনে রক্তাক্ত মেইস উঁচিয়ে পথনির্দেশ করে অহঙ্কারী সেথ। যুদ্ধজয়ের গৌরবে উঁচু সিনা তার। নদের কিনারে নৌকা প্রস্তুত আছে। সবাই নিঃশব্দে উঠে পড়ে তাতে। অনুচররা শক্ত করে ধরে রাখে হাল। তীব্র স্রোতে নদের মধ্যবর্তী রেখায় ভেসে যায় নৌকা। একসময় অনুচররা কফিনটি উঁচু করে ধরে সজোরে ছুঁড়ে দেয় স্বচ্ছ নীলের তীব্র স্রোতধারায়। তারপর উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে, চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে প্রাসাদে ফিরে আসে তারা। কণ্ঠে মাতম। হায় হায়, এ কী হলো! হায় হায়, এ কী হলো! মহান রাজা ওজাইরিস আর নেই। প্রাণের ভাই ওজাইরিস আর নেই। মিশরবাসীর পরম পূজনীয় ওজাইরিস আর নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। সকল আলো নিভে গেছে কিংশিপ মিশরের। ওজাইরিস আমোদ করতে গিয়ে মত্ত অবস্থায় দুর্ঘটনাক্রমে নৌকা থেকে পড়ে নীলনদের তীব্র স্রোতে হারিয়ে গেছে। সারা রাত্রি নীলের বুক চষে বেরিয়েছি। কোথাও কেউ নেই। রাজা ওজাইরিস, ভাই ওজাইরিস, পিতা ঈশ্বর গেবের কাছে ফিরে গেছে সে।

‘স্বামী ওজাইরিসের মৃত্যুর সংবাদে রাণী আইসিস স্তম্ভিত হয়ে যায়।’

আমি দুর্বল ফুসফুসের মানুষ। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাসছে সেথের হাতে ধারালো রক্তমাখা মেইস। মনে হচ্ছে আমিই রঙমহলের শেষ আমন্ত্রিত অতিথি। ঘাড়ের উপর সেথের নিঃশ্বাসের শব্দ। এই বুঝি নেমে এল মেইসের নির্মম আঘাত। হঠাৎ কাঁধের উপর ভারী হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি। বৃদ্ধ লোকটার লম্বা হাত। মুখ উঁচিয়ে তার দিকে তাকাতেই হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যায় শরীরের ভেতর দিয়ে। কী ভয়ঙ্কর, কী ভয়ঙ্কর চোখ! আমি তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠি।

‘ভয় পেওনা, বালক! ইতিহাস এমনই হিংস্র। এই-ই তো ঘটে চলেছে দিকে দিকে, গত পাঁচ হাজার বছর ধরে। সেথই তো এই হিংস্রতার সূচনাকারী। হিংসা ষড়যন্ত্র হত্যা পাপ প্রভৃতি শব্দের জন্ম তো সেথেরই হাতে। তোমরা পৃথিবীর মানুষ সেথের কাছ থেকেই তো সব শিখেছো। সেথ এই বীভৎসতা না দেখালে তোমরা হয়তো আজো স্বর্গের শান্তিপূর্ণ জীবনই যাপন করে যেতে।’

বৃদ্ধ লোকটি আমাদেরকে প্রার্থনা কক্ষের বাইরে নিয়ে আসে। টেম্পলের উত্তরে ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীরের একটি পাথরের উপর আমাকে বসিয়ে দেয়। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। রোদের সেই তেজ নেই। সামনে লেক নাসেরের অনন্ত নীল জলরাশি। এদিকটা জনমানবহীন। ফাতমা আলাব্রি খসে পড়া একটি পাথরের উপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। দু’চোখে জল। জেসিকা মেরেসি আমার পাশে বসে হাতের আঙুল টেনে টেনে দিতে থাকে।

‘রাণী আইসিস মন্দিরের মূল প্রার্থনাকক্ষে ঢুকে তামারিস্কের দ্বার বন্ধ করে দেয়। প্রার্থনা বেদির পাথরে মাথা কুটতে থাকে। পিতা ঈশ্বর গেব, দেখা দাও। দেখা দাও। ওজাইরিসের এই পরিণতি আমি মানি না। আমি বিশ্বাস করি না ওজাইরিস তোমার কাছে ফিরে গেছে। সে আমাকে এভাবে ফেলে যেতে পারে না। শয়তান সেথ নিশ্চয় তাকে হত্যা করেছে।

‘আমি অন্ধকারে নীলের পাড়ে উপত্যকায় চিৎ হয়ে শুয়ে পূব আকাশে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করছি। পাপবোধ আর আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যন্ত্রণায় কপালের শিরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তীব্র মশালের তীক্ষ্ণ আঁচে মুখ প্রায় ঝলসে যায়। রাণী আইসিস ও নেপথিস মশাল হাতে আমার মুখের উপর দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য! এই গভীর অন্ধকারে, এই দুর্গম উপত্যকায় দুই নারী মশাল হাতে! আমি আইসিসের মুখে দৃষ্টিপাত করি। তার দু’চোখ দিয়ে নূর বের হচ্ছে যেন। কী তীব্র তার ঝলক! মনে হতে থাকে আইসিস আমাকে ভষ্ম করে দিচ্ছে।

‘আইসিসের রূপ মানবিক নয়, ঐশ্বরিক। তোমরা অনুমান করতে পারো? আমি ওজাইরিসের বিশ্বস্ত বান্দা। আইসিসের শয়নকক্ষ অবধি আমার অবাধ যাতায়াত। আমি তার রূপ দেখেছি। ভাল করেই দেখেছি। বহুবার। কিন্তু আজ যেন মিলছে না। আজ সে অন্যরকম। আমি হাঁটু গেড়ে মাথা নামিয়ে তার সামনে বসে পড়ি। জানি আমার সকল পাপ সে দেখতে পাচ্ছে। আমার মুক্তির কোন পথ খোলা নেই।

‘কিন্তু তার কণ্ঠস্বর বড় কোমল। তুমি ওঠো। উঠে দাঁড়াও। আমাদের বহুদূর যেতে হবে। বহু কাজ বাকি। তোমার সাহায্য বড় প্রয়োজন।

‘ঢালু উপত্যকার অমসৃণ পাথুরে পথ বেয়ে নীলের কিনার অবধি নেমে যাই। সামনে আইসিস। পেছনে নেপথিস। ফাল্লুকা প্রস্তুতই আছে। শক্ত মাঝি-মাল্লার দল নীলের তীব্র স্রোতের অনুকূলে দ্রুত দাঁড় বাইতে থাকে। আমরা ভেসে চলি অজানায়।

‘এর পরের কাহিনী দীর্ঘ। তোমরা জানো, আইসিস সাধারণ মানবী নয়, সে দেবী। পিতা ঈশ্বর গেবে’র কাছ থেকে সে ঐশ্বরিক ক্ষমতা লাভ করে। বিদ্যদৃষ্টি পায়। সে জেনে যায়, ওজাইরিসের কফিন ভেসে গেছে উত্তরে, ভূমধ্যসাগরের ফিনশীয় উপকূলের দিকে। বিবলস শহরের উপকণ্ঠে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক জঙ্গলে আটকে আছে। আইসিস কফিন উদ্ধার করে এগিলকিয়ায় নিয়ে আসে। ভেতরে ওজাইরিস। শান্ত, মায়াময়। যেন গভীর ঘুমে মগ্ন।

‘রাজকীয় প্রাসাদে ওজাইরিসকে ফিরিয়ে নেয়া বিপজ্জনক ছিল। নিশ্চয়ই শয়তান সেথ ধারালো মেইস হাতে সেখানে অপেক্ষায় আছে। ততক্ষণে সে নিজেকে ঈশ্বর গেবে’র প্রেরিত রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আইসিস-নেপথিসকে খুঁজে পেতে সে মিশর এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেড়াচ্ছে।

‘এগিলকিয়া প্রাসাদের অদূরে আবিদোস মরুভূমির এক গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে আইসিস। আত্মগোপন করে ফেলে নিজেদের। অস্থির আইসিস। নির্ঘুম। উদ্বিগ্ন। পিতা ঈশ্বর গেবে’র সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে তার প্রতি। যে কিংশিপ পিতা প্রতিষ্ঠা করে দিলেন, প্রিয়তম ভাই ওজাইরিস যে কিংশিপের রাজা, তার উত্তরাধিকার কোথায়! শয়তান সেথ! না, সে মিশরীয় কিংশিপের উত্তরাধিকারের যোগ্য নয়। সে পিতা ঈশ্বর গেবে’র যোগ্য প্রতিনিধি হতে পারে না কিছুতেই।

‘এরপর আমি দু’চোখ ভরে আইসিসে’র কঠোর সাধনা দেখে গেছি। সে কী কঠিন তপস্যা। স্বর্গের ৪২ জন দেবতাকে তুষ্ট করতে হবে। পিতা ঈশ্বর গেব তো অবশ্যই কন্যা আইসিসের চূড়ান্ত অনুরতির পরীক্ষা নেবেন। একনিষ্ঠ অনুরক্তির মাধ্যমে ক্রিয়েটর গড এতুম-কেও উতরে যেতে হবে। দেবতা থোথ অবশ্য আইসিসের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল। তার সাহায্য হয়তো পাওয়া যাবে। মিশরীয় কিংশিপের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে একটি পুত্র সন্তান চাই আইসিসের। চাইই। যে কোন উপায়ে। তার নাম হবে হোরাস। মহাবীর হবে সে। আইসিস তাকে নিজ গর্ভে ধারণ করবে।

‘কিন্তু হায়, রাজা ওজাইরিস তো মৃত! বহুমূল্য কফিনে চিরশান্তিতে শায়িত। সন্তানের জন্ম দিতে তো পুরুষকে পুরুষ হয়ে পুরুষত্ব প্রদর্শন করতে হয়! কিন্তু তা’ কী করে হতে পারে! ওজাইরিস! সে তো শেষকৃত্যের অপেক্ষায়! আইসিস কি বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছে?

চার পর্বে সমাপ্ত ই-বুক

অপর তিনটি পর্ব পড়ুন:

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

হ্যানক গাঁয়ের রঙ

কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

মারশা মাতরুয়াহ’র নির্জনতায় প্রেম

ভূমধ্যসাগরের তীরে মিশরের শান্ত সিগ্ধ অনন্যসুন্দর মারশা মাতরুয়াহ ভ্রমণের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিক্ষেত্র, মরুভূমির এগ্রিকালচার আর মাতরুয়াহ’র সান্ধ্য-জীবন। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি পাবার প্রয়োজন কি!

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.