কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

Share on social media

মধ্য নভেম্বরেই কোরিয়ায় হাড়কাঁপানো শীত। তাপমাত্রা শূন্যের ওপারে। ওয়নজু এক্সপ্রেস টার্মিনাল থেকে ঠিক ন’টায় বাস স্টার্ট করে। শহর পেরিয়ে আমাদের ইয়োনসেই ইউনিভার্সিটির সামনে দিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলে এক্সপ্রেসওয়ের দিকে। ওয়নজু থেকে জিয়নজু তিন ঘণ্টার পথ। হ্যানক ভিলেজ দেখবো, পৃথিবীর অন্যতম প্রধান স্লো-সিটি। অনেক গল্প শুনেছি এর। এক ধরনের থ্রিল অনুভব করতে থাকি ভেতরে ভেতরে।

আমাদের ন’জনের দল। দু’জন কোরিয়ান। জেকে-জেমিন জুটি। ইয়োনসেই’র সিনিয়র স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটির ওরিয়েন্টেশনের দিনগুলোতে ওরা আমাদের গাইড টিমের সদস্য ছিল। ভীষণ উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত। ওরাই আমাদের ফুসলিয়ে এই ট্যুরে শরিক করেছে। শীতের কারণে কোর্সের অনেকে শেষ অবধি পশ্চাৎপসারণ করায় টিমের সাইজ ছোট। কম্বোডিয়ার সুন হিং, পূর্ব তিমুরের জোয়াও মোরেইরা, ইকুয়েডরের কার্লোস রবার্তো, ইরাকের হাওদাং বলি, মিয়ানমারের নুয়ে-উ, ভিয়েতনামের নুয়েন মিন, আর আমি, বাঙাল। টিম ছোটই ভাল। চ’লে শান্তি।

জিমিন চুলের স্টাইল বদলে নিয়েছে সেদিন। ওকে দেখে চিনতেই পারিনি। ইয়োনসেইর ধনী বাচ্চা মেয়েগুলোর কাজই স্টাইলের উপর স্টাইল মারা। দেড়শ’ বছরের পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়। কোরিয়ার নাম্বার ওয়ান। তাও আবার বেসরকারি। এখানে সুযোগ পাওয়ার জন্য কমপক্ষে দুটো কোয়ালিটি থাকা মাস্ট। বাপের টাকার গাছ, আর অবিশ্বাস্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারার যোগ্যতা। কোন কোটা-ফোটার ব্যাপার নেই। প্রশ্ন ফাঁসের প্রশ্নই আসে না।

সেদিন মেইজি-রি গেছি কফি খেতে। ‘রি’ মানে রাস্তা। ইয়োনসের সামনের আবাসিক এলাকার নাম। অবশ্য আবাসিকের চেয়ে কমার্সিয়াল বলাই ভাল। এতটুকু একটা এরিয়ার মধ্যে দুনিয়ার রেস্টুরেন্ট। পাঁচতলা বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে কফিসপ। মধ্যবয়স্ক এক মহিলা একা চালায়। ধনি মহিলা, পুরো বাড়িটাই তার। তেলরঙের পেইন্টিং করে। দেয়ালে নিজের কাজ ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ইংরেজি বলার খুব শখ। আলাপ ভালই জমে যায়। দুটো ছেলে-মেয়ে। সিউলের এই-সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। নাম মনে থাকে না, একই রকম শোনায় সবগুলো। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমার ঘরের পাশে এত নামকরা ইউনিভার্সিটি, আর ছেলেমেয়েরা সিউলে পড়ে! খুব মনখারাপ করে মহিলা বলে, এখানে সুযোগ হয়নি।

বাসে জিমিনের সাথে বকবক করতে থাকি। পাবলিক পরিবহনে বকবকানির বিপদ আছে। সেদিন সিউল থেকে ফিরছি, আইটিএক্স ট্রেনে। সাথে নেপালের রাজুপ্রসাদ শাহ। খুব জোরে হেসে উঠেছিলাম কি! নাহ, তেমন নয় মোটেও। ও বাব্বা, দেখি কম্পার্টমেন্টের ঐ কোণে গার্ড সাহেব হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে, কথা বলো না, কথা বলো না! অন্যদের ডিস্টার্ব হতে পারে।

দেয়জিয়ন সিটি এক্সপ্রেস বাস টার্মিনালে কুড়ি মিনিটের যাত্রাবিরতি। সামনের এক সেমি-স্ট্রিট ফুড সপে ওডেং অর্ডার করি। মাছের কিমা বেলে নিয়ে লম্বা টুকরো করে কাটে। তারপর তেলে ভেজে কাঠিতে গুঁজে পাতলা সুপে চুবিয়ে রাখে। সয়াসস মাখিয়ে গরম গরম খাও। ওডেংয়ের সাথে সুপ ফ্রি। দুটো খেলে পেট ভরপুর। মধ্যবয়স্ক এক মহিলা একা সবকিছু ম্যানেজ করছে। উচ্চশিক্ষিত সবাই। চাকরি করার চেয়ে নিজস্ব এন্ট্রিপ্রিনিয়রশিপ এদের পছন্দ। স্বাধীনতা আছে, নিরাপত্তার চিন্তা করতে হয় না, নগদ উপার্জন। ভাল লাগে। কিন্তু এখানে ওডেংয়ের দাম বেশি। পার পিস এক হাজার ওয়ন। সিউলের এক্সপ্রেস বাস টার্মিনালেও এমন দেখেছি। সেই তুলনায় কোরিয়ার নিউমার্কেট খ্যাত নামদেমুনে অর্ধেক দামে পাওয়া যায়।

সোয়া বারোটায় জিয়নজু এক্সপ্রেস বাস টার্মিনালে নেমে পড়ি। পাশেই বারান্দায় র‌্যাকের মধ্যে সিটি ট্যুর সংক্রান্ত সুভ্যেনির সাজানো। হাতে তুলে নিই। ঢাকায় হলে ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের পুরানো খবরের কাগজ কেনার দরকার হতো না। কিংবা টিএসসিতে পাছার তলে চালান করে জম্পেস আড্ডা। এখানে ঝালমুড়ি নেই। টিএসসিও নেই। জেকে আমাদের পথপ্রদর্শক। ওর হাতের স্মার্টফোনে গুগল নেভিগেশন চালু। গেস্টহাউস এখান থেকে খানিকটা দূরে। ট্যাক্সিতে যাওয়া যায়। তবে ভীষণ ব্যয়বহুল। তাছাড়া আমরা ন’জনের দল। অচেনা জায়গায় দলচ্যুৎ হলে বিপদ হতে পারে।আমরা সিটি বাস সার্ভিসের জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়াই।

জিয়নজু এখনো রঙিন। পথে পথে হেমন্তের ম্যাপল-জিঙ্কো পাতার জাফরান লাল সবুজ হলুদ সৌন্দর্য্য যেন রূপবতী কোরিয়ান নারীদের মদির চিবুকে প্রতিফলিত হয়ে মরছে। আমাদের ইয়োনসেইর হেমন্তকাল শেষ হয়েছে ক’দিন আগেই। পথে পথে স্তূপ হয়ে থাকা রঙিন পাতার দল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। শুকনো কাঠামো সর্বস্ব নিঃস্ব গাছগুলো শীতের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে যেন। জিয়নজু আমাদের ইয়োনসেই থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে। হয়তো তাই এখানে তাপমাত্রা এখনো সহনশীল। বৃক্ষ, পত্রপল্লবের কাছে শীতের আগমনী বার্তা এখনো পৌঁছেনি হয়তো।

বাসস্টপেজের ছোট্ট যাত্রী ছাউনির একপাশে এলইডি স্ক্রিনে বাসের অবস্থান জানানো হচ্ছে। কোন বাস কত দূরে রয়েছে, ক’মিনিটের মধ্যে পৌঁছুবে সব। বাস ইনফরমেশন সিস্টেমের আওতায় সারা কোরিয়াতেই এই ব্যবস্থা। আর ম্যানুয়াল ম্যাপ তো রয়েছেই। আমরা হৈচৈ করতে করতে বাসে উঠে পড়ি। শুক্রবারের দুপুর। ওয়ার্ক-ডে। যথেষ্ট ভীড়। ড্রাইভারের পাশে বসানো মেশিনে টি-মানি কার্ড ছুঁইয়ে ভাড়া চুকিয়ে দিই। এ এক অসাধারণ ব্যবস্থা। এক টি-মানি কার্ড দিয়ে কোরিয়ার সকল সাবওয়ে কিংবা সিটি বাস সার্ভিসে অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। প্রয়োজনে ফ্লেক্সিলোডের মত রিচার্জ করিয়ে নিলেই হলো। অনেককে দেখেছি এ কার্ড সেলফোনের ব্যাক কাভারে রাখে। আমার ব্যাংক ডেবিট কার্ডও এই কাজ করতে পারে। তবে বাঙাল তো, যেখানে সেখানে ব্যাংক-কার্ড বের করার সাহস পাইনে।

হ্যানক ভিলেজ জিয়নজু সিটির উপকণ্ঠে পড়েছে, নর্থ জিয়ল্লা-বাক প্রভিন্সের মধ্যে। জিয়নজু নদীর পাড় ঘেঁষে। ছোট্ট নদী। জলশূন্য, মৃত মনে হয়। শীতকাল বলেই হয়তো। তবে সুরক্ষিত নদীগর্ভ ও দু’পার।

ভিলেজে আটশর মত বাড়ি আছে। নির্মাণশৈলী কোরিয়ার প্রাচীন বাড়ির অনুকরণে। এ এক নতুন ধরনের সভ্যতা। আধুনিকতম নগর জীবনের সমান্তরাল একেবারেই প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণে গ্রামীণ সভ্যতা। এখানকার ধনী গ্রামবাসীরা এই ঐতিহ্য লালন করে আসছে। এর যে ভৌগলিক অবস্থান, তাতে খুব সহজেই সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করা যেতো। এরা উল্টোটা করেছে। ফলও ফলেছে ভাল। হ্যানক ভিলেজ আজ কোরিয়ার অন্যতম প্রধান ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। মানুষ এখানে দুদণ্ড স্লো-জীবনের স্বাদ নিতে আসে।

মধ্যযুগে জসন ডাইনেস্টির সময়কালে হ্যানক এলাকা পারমার্থিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত হতো। এর শান্তিময় জীবন, ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আর প্রকৃতির কোমল পরশের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজনের জন্য ২০১০ সালে এ ভিলেজ বিশ্বের সেরা ‘স্লো-সিটি’র তকমা অর্জন করে।

ভিলেজের খুব ভেতরেই আমাদের গেস্ট হাউস। জেকে আগে থেকেই অনলাইনে বুকিং দিয়ে রেখেছিল। মূলতঃ একটি বাড়ি। অনন্যসাধারণ ট্র্যাডিশনাল কোরিয়ান ডিজাইনে তৈরি। দুনিয়ার গাছ লতা পাতা ফুল দিয়ে মোড়া। বাড়ির মালিক বুড়ো-বুড়ি। এক অংশে নিজেরা থাকে, আরেক অংশে ব্যবসা। ইন্টেরিয়র এক্সেরিয়র সব ঝকঝকে তকতকে নতুন। হালের তৈরি, নাকি পরম যত্নের ফল, কে জানে! জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করি। রুমের ভেতরে খাটের ব্যাপার নেই। ফ্লোরিং। উপরে আবার হাফ অংশে দোতলা। কোণের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হয়। নুয়েন মিন ভিয়েতনামের একটা ইউনিভার্সিটির গবেষণা কর্মকর্তা। বয়সে জুনিয়র। ওকে ঠেলে উপরে পাঠিয়ে দিই। চকচকে কাঠের ফ্লোর। ধবধবে সাদা বিছানা। ইলেক্ট্রিক হিটিং সিস্টেমে উত্তপ্ত প্রায়। সব গরম হয়ে যাচ্ছে। কী যন্ত্রণা! সুইচ বন্ধ করে দিই। কিন্তু ঠাণ্ডা হতে সময় লাগবে। ফ্রেশ হওয়ার জন্য একঘণ্টার সময় বরাদ্দ। লাঞ্চ টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। কোরিয়াতে বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে লাঞ্চ করার রীতি। আবার সন্ধ্যা সাতটার পর আমাদের ক্যাম্পাসের রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন ডিনার করতে চাইলে মেইজি-রিই ভরসা। মধ্যরাত্রি অবধি জমজমাট। ডিনার, পানীয়, উন্মত্ততা সবকিছু।

হ্যানক ভিলেজ এরিয়ার ভেতরে জিঙ্কো ট্রি এভিন্যুর একটা রেস্টুরেন্টে আমরা লাঞ্চ করবো। বুকিং দেয়া আছে। ট্র্যাডিশনাল খানাপিনা। হাঁটতে থাকি ভিলেজের মূল আকর্ষণ তেজেরো স্ট্রিট ধরে। হঠাৎ করেই যেন আধুনিক জীবন থেকে বেরিয়ে প্রাচীন কোরিয়ায় প্রবেশ। কী বিস্ময়! কী অসাধারণ আয়োজন! কত প্ল্যান পরিকল্পনা করে, কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করে আধুনিকতার সকল আয়োজন এখানে বহিষ্কার করা হয়েছে। সর্বত্র শিল্পীর তুলির আঁচড় যেন। আমরা মধ্যযুগের কোরিয়ান সোসাইটিতে ঢুকে পড়ি।

তরুণ-তরুণীর জুটি অসাধারণ সব পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। কী ভীষণ রঙিন! মেয়েদের চুল ট্র্যাডিশনাল লুকে পরিপাটি। খোঁপায় ফুল গুঁজে গুঁজে রাখা। পায়ে কনে জুতো। পোশাক দেখবো, নাকি সৌন্দর্য্য! জিমিনের দ্বারস্থ হই। এই পোশাকের রহস্য কি, জিমিন? ও জানায়, এর নাম হ্যানবুক। ট্র্যাডিশনাল কোরিয়ান কস্টিউম। তোমরা এখানে যা দেখছো, এর ডিজাইন, রঙের ব্যবহার অরিজিনাল হ্যানবুকের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতর নিশ্চয়। এটাকে হ্যানবুকের ফিউশন বলতে পারো। পোশাকে যাদেরকে দেখছি, এরা তো প্রায় সবাই কোরিয়ান তরুণ-তরুণী? হ্যাঁ। কোরিয়ান তরুণ-তরুণীরা এখানে এসে হ্যানবুক পরে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। এর মধ্য দিয়ে হয়তো তারা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো! এখানে অনেক শোরুম রয়েছে যারা হ্যানবুক ভাড়া দেয়। দশ হাজার ওয়নের মধ্যেই দুই সেট পেয়ে যাবে হয়তো। সাথে অঙ্গসজ্জা ফ্রি। জিমিন হো হো করে হাসতে থাকে। আমি মাফ চাই। বাঙাল চামড়ায় এই মহারঙিন হ্যানবুক আমাকে মানাবে না। তাছাড়া এটা তো জুথবদ্ধতার ব্যাপার। ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে!’

ভিলেজের রাস্তাগুলো বিশেষভাবে তৈরি। পাথরের। ফুটপাথ বৃক্ষ ফুল লতাগুল্মে সুশোভিত। খোলা নালা দিয়ে স্বচ্ছ পানির স্রোত বয়ে চলেছে। কি কারণে এই জলপ্রবাহ, কে জানে! দু’ধারে সারি সারি বাড়ি। হ্যানক। গাঢ় ধূসর টালির চালার দু’কোণা বেঁকে উঁচু হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে।

কাঠামোর সবকিছু কাঠের তৈরি। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ির কারুকাজ যেন আরও মনোহর। বসতবাড়ির ঘরের জানালায় কাঁচ নেই। কাঠের ফ্রেমের ভেতরের দিকে স্থানীয় পদ্ধতিতে তৈরি কোরা কাগজ মোড়া। বাড়ির সামনের অংশে কিংবা পুরো বাড়ি জুড়েই দোকান। খাবারের, হস্তশিল্পের, পোশাকের, হ্যানবুকের।

আমরা লাঞ্চের জন্য নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করি। এটাও আসলে একটা হ্যানক। বাড়ির তিন দিকে তিনটি ঘর। একটাতে রেস্টুরেন্ট, একটাতে কিচেন। অন্য দিকে হয়তো এরা বাস করে। মাঝখানে বড় উঠোন। কালো পাথর বিছানো। এদের পারিবারিক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। মা মেয়ের ব্যবস্থাপনা। দুটো জলচৌকি জোড়া দিয়ে আমরা ন’জন বসে পড়ি। গরম ফ্লোরে বসার জন্য চৌকোণো পিলো। খাবার আসতে থাকে। সাজানো হতে থাকে জলচৌকিতে। অসংখ্য পদ। সত্যিই অসংখ্য। রকমারি। বাহারি। বিচিত্র। ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা তারচেয়ে তীব্র। পদগুলোর নাম মনে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা বৃথা যেতে থাকে। রসনার চেয়ে দ্রষ্টব্য শান্তি।

রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক-কাম-কুক-কাম-ওয়েটার মা-মেয়েকে ‘খামসা হামনিদা’ জানিয়ে বেরিয়ে আসি ভিলেজের রাস্তায়। এই রকম অসম্ভব একটা ভোজনের আয়োজন করার জন্য জেকে-জিমিনকে ধন্যবাদ জানাই। কোরিয়ার জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় খাবার খুব ব্যয়বহুল বলা চলে না। আমাদের জনপ্রতি খরচ বিশ হাজার ওয়ন। বাংলাদেশি পনের শ` টাকার একটু বেশি। গত কোরবানির ঈদে নামাজ পড়তে গেছি সিউলের ইতোয়ান মসজিদে। নামাজ শেষে দল বেঁধে লাঞ্চে ঢুকেছি একটা তুর্কি রেস্তোরায়। বুফে সিস্টেমে খাওয়া। আমার পনের হাজার ওয়ন প্রায় জলে গেছে। সেই তুলনায় হ্যানক ভিলেজের এই মধ্যাহ্নভোজ সত্যিই অতুলনীয়। স্মৃতিময় হয়ে থাকবে।

তেজেরো স্ট্রিট ধরে এগুতেই দেখি জিয়ঙ্গিজিয়ন টেম্পলের সামনের রাস্তা আর খোলা আঙিনায় রঙের মেলা বসেছে। অসংখ্য তরুণ-তরুণী হ্যানবুকে সেজে সেলফিতে ব্যস্ত। মাথার উপরে লাল হলুদ জাফরান ম্যাপল-জিঙ্কো বৃক্ষের তীব্র স্পটলাইট। নারীর সৌন্দর্য্য, প্রকৃতির রূপ আর স্থাপত্য নান্দনিকতা সব একাকার যেন। চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রাণ ভরে ওঠে।

টেম্পলের বিপরীতে জিয়নডং ক্যাথেড্রল। ইউরোপীয় স্থাপত্য নকশায় নির্মিত। লাল ধূসর রঙে শতবর্ষের গির্জাটি বিশালতা নিয়ে স্ব-মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। হ্যানবুক জুটিরা এখানেও ভীড় করে আছে। মনে মনে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সেরে নিচ্ছে নাকি? কে জানে!

হ্যানক ভিলেজে সন্ধ্যা নামছে। ঠাণ্ডার তীব্রতা বাড়ছে। কিছু বিশ্রাম দরকার আমাদের। গেস্টহাউসে ফিরে যেতে চাই। পাশে পাংনামুন গেট পেরিয়ে নাম্বু (কৃষক) নাইট মার্কেট জিয়নজুর আরেক আকর্ষণ। ওটাও দেখতে চাই একবার। জীবনের কোন কিছুই তো দু’বার দেখার সুযোগ হয় না। পৃথিবীর পথে পথে যে মানুষগুলোর সাথে দেখা-আলাপ-পরিচয়-বন্ধুতা হয়, কাউকেই তো আর দ্বিতীয়বার পাবার উপায় নেই। মায়া বাড়ে, স্মৃতি ভারী হয়। ভরে ভরে ওঠে ছবির ফোল্ডার। এক জীবনে সময় যে বড় কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

মারশা মাতরুয়াহ’র নির্জনতায় প্রেম

ভূমধ্যসাগরের তীরে মিশরের শান্ত সিগ্ধ অনন্যসুন্দর মারশা মাতরুয়াহ ভ্রমণের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিক্ষেত্র, মরুভূমির এগ্রিকালচার আর মাতরুয়াহ’র সান্ধ্য-জীবন। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি পাবার প্রয়োজন কি!

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.