ভূমধ্যসাগরের তীরে মিশরের শান্ত সিগ্ধ অনন্যসুন্দর মারশা মাতরুয়াহ ভ্রমণের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিক্ষেত্র, মরুভূমির এগ্রিকালচার আর মাতরুয়াহ’র সান্ধ্য-জীবন। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি পাবার প্রয়োজন কি!

Share on social media

এই ভর-সন্ধ্যায় মারশা মাতরুয়াহ ঘুমিয়ে আছে। চারদিকে নৈঃশব্দ্য। মায়াবি বাড়িগুলো অন্ধকার নির্জনতার চাদরে মোড়া। শান্ত সড়ক ঘেঁষে দু’চারটে ক্যাফে চোখে পড়ে শুধু। বাইরে ফুটপাতে টেবিলগুলো ফাঁকা ফাঁকা। কোথাও ভারী টুপিতে কান ঢেকে দু’চারজন বুড়ো টেলিভিশনে ফুটবল আর মুখে শিসা নিয়ে মগ্ন। আলো-আঁধারির ভেতর নিচু শব্দে টেলিভিশনের স্ক্রিন দ্রুত দৃশ্যপট বদলে চলে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছি। অচেনা শহর। নভেম্বরের শেষের হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে দু’হাত জ্যাকেটের পকেটে। হুড কপাল অবধি টেনে রাখা। হঠাৎ জবুথবু পথচারী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে যায়। চামড়ায় বাংলার চিরচেনা রঙ, লুকোই কীভাবে! স্ফটিক-স্বচ্ছ ফিরোজা-নীলাক্ষি মারশা মাতরুয়াহ’র সাথে আমার এই অসম প্রেম এরা মেনে নিতে পারে না। শিহরণ বোধ করি।

আজই বিকেলে পৌঁছেছি এখানে। সেই কাকডাকা ভোরে কায়রোর উপকণ্ঠে আমারান্তে পিরামিড হোটেল থেকে বেরিয়েছি বাসে করে। আলেক্সান্দ্রিয়া ডেজার্ট হাইওয়ে সোজা উত্তরে ভূমধ্যসাগরের দিকে ধেয়ে গেছে, এল-আলামেইন শহর অবধি। দুশ’ সত্তর কিলোমিটার অনন্ত মরুর বাধাহীন মহাসড়ক। আলামেইনের খ্যাতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশিষ্ট রণক্ষেত্র হিসেবে। এটি মিশরের পশ্চিম উপকূল, ভূমধ্যসাগরের পাড়ে। ওপারে অর্থাৎ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিলেই ইউরোপ। আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোকে আয়ত্ত্বে নিতে এই বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল কৌশলগত দিক দিয়ে জার্মান ও ব্রিটিশ উভয় বাহিনীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের গাইড কাম ইংরেজি অনুবাদক বহুভাষী গামাল আদ্রায়েজ জানালেন, জার্মান নাৎসী ফিল্ডমার্শাল এরউইন রোমেল পশ্চিম উপকূলে মিত্রশক্তির দুর্বল রক্ষণব্যুহ সম্পর্কে ভাল করেই জানতেন। সুতরাং তিনি এখানে ব্রিটিশ সেনাপতি লে. জেনারেল বার্নার্ড মন্টগোমারির উপর মরণ কামড় বসিয়ে দেন। ফলাফল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, পরাজয় এবং উভয়পক্ষের ৫০ হাজার সেনার করুণ মৃত্যু। রোমেল নিজেও এখানে আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। সাধে কি তাকে ডেজার্ট ফক্স উপাধি দেয়া হয়েছিল!

আলামেইনে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে কাছাকাছি তিনটি সমাধিক্ষেত্র। প্রথমটি নাৎসী জার্মানদের। এখানে স্মৃতিসৌধ, সমাধিক্ষেত্র এবং ছোট্ট সংগ্রহশালা রয়েছে। বাইরে জার্মান পতাকা পতপত করে উড়ছে। পাশেই ইতালীয় সমাধিসৌধ। সড়কের ওপাশেরটা বৃটিশদের। সবই মিশরীয় লাইমস্টোনের, ধূসর লালচে। এগুলো দেখভাল করে যথাক্রমে জার্মান, ইতালি ও ব্রিটিশ সরকার। হ্যাঁ, জার্মান, ইতালি ও ব্রিটিশ সরকার। ভুল বলছি না।

কিন্তু আমার লক্ষ্য স্ফটিক-স্বচ্ছ ফিরোজা-নীলাক্ষি অপরূপা মারশা মাতরুয়াহ। আরো দুশ’ কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে, পশ্চিম উপকূল বেয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল হাইওয়ে হয়ে। এ মহাসড়ক ভূমধ্যসাগরকে চোখের ডানকোণে রেখে সোজা পশ্চিমে লিবিয়া উপকূলের দিকে এগিয়ে গেছে।

ইজিপ্শিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এগ্রিকালচারের (EICA) ভলভো গ্রেহাউন্ড বাস। ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে চলেছে ভূমধ্যসাগরের পাড় বেয়ে, মারশা মাতরুয়াহ’র দিকে। বাসে আমরা ২২-২৩ জন লোক। ১৭ জনই বিদেশি। তিন মহাদেশের। এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার। সমুদ্র দেখা আমার জন্য নতুন নয়। অনেক দেখেছি। কিন্তু এ যে ভূমধ্যসাগর! এর জল কি শুধুই জল! ‘ফিরোজা-নীল রঙ’ মেখে মৃদুমন্দ মন্থন করে চলেছে চোখের সামনে। কেবল তাই নয়, এখানে রয়ে গেছে বীর ফারাও রাজা দ্বিতীয় রামসিসের ঐশ্বর্যময় পদচিহ্ন। রয়েছে তারুণ্যের ঘুম হারামকারিনী রহস্য রাণী ক্লিওপেট্রা কিংবা বিশ্বজয়ী মহাবীর আলেক্সান্ডারের কত না স্মৃতি!

মহাসড়কের বাম দিকে মরুভূমির ভেতরে এখানে সেখানে মিশরীয় কৃষকদের ফসল ফলানোর কঠোর চেষ্টার ছাপ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে ‘ফিগ’ ফলের রুক্ষ রাগান। ফিগ মিশরীয় মরুভূমি অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ফল। খর্বাকৃতির মোটা ডাঁটা-সর্বস্ব গাছ। মরুভূমির মাটি ও আবহাওয়ার জন্য বেশ উপযাগী বটে।

মারশা মাতরুয়াহ পৌঁছাতে সেই বিকেল। আমাদের হোটেল আরুস এল বাহার। রিসিপশনে আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশিক্ষণ লাগে না। আমাদের জন্য বুকিং করাই ছিল। আর গেস্টও তেমন নেই এ সময়। ফ্রেশ হওয়ার জন্য আধাঘণ্টা সময় পাওয়া গেল। বিকেল বেলায় লাঞ্চ, হোটেলের নিচের রেস্টুরেন্টে। তিনতলার নির্ধারিত রুমে আশ্রয় মেলে। আগামী ছ’দিন এ-ই ঠিকানা। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সামনে চকচকে মসৃণ সড়ক। আরবীয় খেজুর গাছ। গ্রিক ডিজাইনের ল্যাম্পপোস্ট সারি সারি। এরই সাথে অবারিত ভূমধ্যসাগর। স্বপ্নের মারশা মাতরুয়াহ। কী অপরূপ জলরাশি! কী অসাধারণ সমুদ্র!

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে মারশা মাতরুয়াহ’র বুক জুড়ে, বেশ কিছু আগে। ভূমধ্যসাগরের গভীর অন্ধকারে অচেনা জাহাজের মৃদু আলোকচ্ছটা চোখের ভেতরে ঢুকে পড়ে অজান্তেই। নিচের চকচকে রাস্তায় সাঁ আওয়াজে বেরিয়ে যায় কয়েকটি গাড়ি। নির্জনতা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে শুভ্র শয্যায়। বাইরের বাতাসে হাড় হিম করা শীতলতা। সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করি। মাথার মধ্যে কেমন ফুরফুর করতে থাকে ভাললাগাগুলো। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে মাতরুয়াহ’র গভর্নর মেজর জেনারেল আ’লা আবু জিইদের বাড়ি। ছবির মত সুন্দর। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত চারদিক। জেনারেলের বউ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভূমধ্যসাগরের ফিরোজা-নীল জলে সূর্যোদয় উপভোগ করেন রোজ। বাইরে কালো ইউনিফর্ম পরা আর্মির সতর্ক প্রহরা। আমাদের র‌্যাবের মতই। তবে বয়স বড় কম। ছেলেগুলোর চুল নিচু করে ছাঁটা নয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কেমন আর্মিরে বাবা!

সমুদ্র ছেড়ে শহরের দিকে মোড় ঘুরতেই ডোয়া’র সাথে দেখা। আমাদের আরেক অনুবাদক, ফ্রেঞ্চ বিশেষজ্ঞ। ওর ফেসবুক পাতা জুড়ে অদ্ভুত সুন্দর সব ঘোড়ার ছবি। মাথায় ছেলেদের ক্যাপ, চুলের গোছা ক্যাপের পেছন দিয়ে বের করা। পরনে চকচকে গোলাপী শার্ট। দেহের বাঁকে বাঁকে নির্মল আহ্বান। ইজিপ্সিয়ান মেয়েরা পোশাকে চৌদ্দআনা ইউরোপিয়ান। বাকি দু’আনা ওদের নিজেদের। সেটা মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বানানো স্কার্ফ। ডোয়া’র মাথায় স্কার্ফ নেই। কখনোই দেখিনি। ক্যাপই ওর স্টাইল। ব্যাখ্যা ওই দেয়। মিশরে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী ১০ ভাগের মত। মূলতঃ কপ্টিক। মুসলিমদের সাথে তাদের পোশাকের পার্থক্য এই স্কার্ফেই। ডোয়াও কপ্টিক। স্কার্ফ দিয়ে চুল লুকিয়ে রাখার কারণ সহজেই অনুমেয়। কিন্তু শরীরের বাঁকগুলো উন্মুক্ত রেখে কেবল চুলের আড়াল কেন! ডোয়া’র জবাব ছিল অভিনব। মিশরীয় নারীর চুল কেবল তার স্বামীরই জন্য। অন্য কারো দেখার সুযোগ নেই। এরপর আমি যা মন্তব্য করি, শুনে তেড়ে মারতে আসে ডোয়া।

ইজিপ্সিয়ান গ্রাজুয়েট তরুণদের এক বছরের সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। গভর্নরের বাড়ির সম্মুখে বালির বস্তার বাঙ্কার বানিয়ে মেশিনগান তাক করে রেখেছে এই প্রশিক্ষণার্থী গ্রাজুয়েট তরুণদেরই একটি দল। শিক্ষিত তরুণরা কর্মজীবন শুরু করবে দেশরক্ষার সর্বোত প্রস্তুতি নিয়ে। ভাবতে ভাল লাগে। অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা রয়েছে, শুনেছি। ডোয়া, এ প্রশিক্ষণে তোমার অভিজ্ঞতা আমাকে বলবে কি? না না, আমাকে তো এ প্রশিক্ষণ নিতে হয়নি! মানে কি, তুমি কি তাহলে গ্রাজুয়েট নও! হুম, মজার ব্যাপার আছে। আমি একজন ইজিপ্সিয়ান মহিলা। দেশরক্ষার দায়িত্ব আমার স্বামীর, আমার ভাইয়ের। আমি কেবল সন্তান প্রতিপালন করবো। আর্মির কাজ আমার না। ডোয়া হো হো করে হাসতে থাকে।

ডোয়া’র সহযাত্রী হয়ে হাঁটতে থাকি। এ শহর মিশরের অন্যতম বৃহৎ গভর্নরেট মাতরুয়াহ’র কেন্দ্রস্থল। প্রাদেশিক রাজধানীও বটে। আয়তন দুইলক্ষ ১২ হাজার ১২১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা মাত্র চার লক্ষ ২৭ হাজার। বিখ্যাত ইজিপ্সিয়ান বেদুঈন জনগোষ্ঠীর বাস মাতরুয়াহ’র মরুভূমির আরও গভীরে। আরব্য রূপকথার সেই বেদুঈন। এখন এরা যথেষ্টই আধুনিক। পশুপালন মূল পেশা রয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু বৃষ্টির জল হারভেস্ট করে মরুর উপত্যকায় এরা ফসলও ফলাচ্ছে ঢের। এ নিয়ে সরকারের বিপুল কর্মোদ্যোগ চোখে পড়ে। বছরের এই সময়ে অর্থাৎ শীতকালে সামান্য বৃষ্টি হয়। গড়ে ১৫০ মিলিমিটারের মত। মরুভূমির চিরতৃষ্ণার্ত উদ্ভিদের জন্য তা’ হাহাকার বাড়ায় মাত্র। জলের প্রতিটি ফোঁটা তাই মহামূল্যবান। আগামী ছ’দিন সেসব দেখার শিডিউল সাজানো রয়েছে।

মারশা মাতরুয়াহ’র পাবলিক লাইব্রেরির সামনে একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসি। বাইরে ফুটপাতে বেতের সোফার আয়োজন। বড় মনোরম। লাইব্রেরির আঙিনায় একদল কিশোর ছুটোছুটি করছে। মায়েদের সাথে এসেছে। এই ভর সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে মহিলারা লাইব্রেরিতে কেন! বোঝার চেষ্টা করি। ডোয়া জানায়, সম্ভবত কোন প্রোগ্রাম চলছে ভেতরে। হতে পারে ছবি আঁকা। কিংবা মিউজিক। ভাল লাগে বাচ্চাগুলোকে দেখে। লাইব্রেরির ডিজাইন একান্ত মিশরীয়। এদেশের সবকিছু মিশরীয়। আরব নয়। ব্রিটিশ নয়। আফ্রিকানও নয়। শুধু মিশরীয়, কখনো গ্রিক মিশ্রন। বড় কোন ভবন প্রথম দর্শনেই ক্লিওপেট্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফারাও রাজাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাম পা একটু সামনে বাড়িয়ে ঋজু ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। ডানহাতে রাজদণ্ড। গর্বিত দু’হাত বুকের উপর ক্রস করে রাখা।

শহরে মানুষ কই, ডোয়া? এত শান্ত কেন এমন সুন্দর সন্ধ্যাবেলা! এত নির্জন। কেমন যেন আপন আপন লাগে! অথচ রাত্রি আটটায় কায়রো সবে জাগতে শুরু করে। কায়রো জেগে থাকে সারা রাত। বিশেষ করে গ্রীষ্মের মরুদাহের দিনগুলোতে। খুব ইচ্ছে ছিল, একদিন সারা রাত হোটেলের বাইরে থেকে কায়রোর রাত্রি উপভোগ করবো। হৈ হৈ করে ঘুরবো কায়রোর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, নীলনদের এপার ওপার। ল্যাতিনো মেয়েগুলোর উৎসাহ আরও বেশি। যেন পা বাড়িয়েই আছে! কিন্তু নিরাপত্তা ইস্যুতে নিরুৎসাহিত হতে হয়েছে। মারশা মাতরুয়াহ কায়রোর বিপরীত। রাত আটটায় এ শহর ঘুমিয়ে পড়েছে যেন।

এসপ্রেসো কফি বারো পাউন্ড পার মগ। সামান্য কটা টাকার জন্য ডোয়া’র সাথে এ সুন্দর সন্ধ্যাটা মাটি করার কোন মানেই হয় না। গরম ভাপ ওঠা কফির ফেনায় চুমুক দিতে দিতে চারপাশ চোখ বুলিয়ে নিই। কাছেই আরেকটা কফি সপ। দুই বুড়ো সারা শরীর চাদরে মুড়িয়ে শিসায় জোরসে দম লাগাচ্ছে। শিসা এদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেবল পুরুষদের নয়, বৃদ্ধদেরও, নারীদেরও। তরুণদেরও। শিসার নলে ঠোঁট লাগিয়ে বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিচ্ছে। গড়গড় শব্দে কাচের ডিব্বার ভেতরের পানি টগবগ করছে। তারপর উগড়ে দিচ্ছে বাতাসে। আলো-আঁধারীর মধ্যে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী মিলেমিশে এক অদ্ভুত মায়াবি পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

ডোয়া শিসার অফার করে। আমি সর্বভুক লোক। চেখে দেখায় দোষ দেখি না। মিশরের সকল শহরের ফুটপাত শিসাখোরদের দখলেই দেখেছি। মাতরুয়াহ থেকে আলেক্সান্দ্রিয়া। তান্তা থেকে কায়রো। লুক্সর থেকে আসোয়ান। সর্বত্র। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি। শুধুই শিসার সার্ভিস দেয় এমন দোকান প্রচুর। টেবিল চেয়ার দখল করে আড্ডা চলে। টেলিভিশনে আরবী মিউজিক ভিডিও বাজে উচ্চস্বরে। সাথে শিসা অবিরাম। আরব আফ্রিকা ল্যাটিনোর দেশগুলোতে এ জিনিস সাধারণ বৈ তো নয়। এমনকি পাকিস্তানেও। ভারতেও। ঢাকায় চোখে পড়েনি তো! পুরোনো ঢাকায় দেখেছি নাকি? মনে করতে পারি না।

শহরের ভেতরের দিকে এগিয়ে যাই। আলো, গাড়ি, আর ইজিপ্সিয়ান নারীর চলাচল এদিকে কিছুটা বেশি। আমি রাতের কুষ্টিয়া শহরের দেখা পেয়ে যাই। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে। ফ্যাশন হাউসগুলো ঝলমল করছে। রাস্তার পাশে কাঁচাবাজার। শসা চার পাউন্ড পার কিলো। নানা রঙের ক্যাপসিকাম। গাজর। বিখ্যাত ইজিপ্সিয়ান রুটির দোকানগুলোর সামনে বৃদ্ধ নারী-পুরুষের ভীড়। গ্রিক ল্যামপোস্টগুলো এলইডি’র আলোয় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে রাস্তার পাশের ঘাসে। কায়রোর তুলনায় এ শহরকে ঘুমন্ত বলাই যায়। তবু ট্রাফিক বাতিগুলোকে উপেক্ষা করার তাড়া নেই চালকদের। ক’জন মাত্র মানুষের বাস মারশা’য়, অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর কী সরব উপস্থিতি!

পিজা হাটস বন্ধ। দোকানের সামনে রাজ্যের ময়লা জমে আছে। কেএসফসি’র দেয়াল ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। ভেতরে একটা কুকুর অলস শুয়ে আছে। হার্ডি নামে ওদের লোকাল একটি ব্র্যান্ড ফাস্টফুড সপও তাই। রাস্তার ওপাড়ে সমুদ্রের গায়ে ম্যাকডোনাল্ড দেখে এসেছি। ওটাই ভরসা। তাও নাকি কাল থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব কি! এমন তো শুনিনি কোনদিন। ডোয়া জানায়, মারশা মাতরুয়াহ’র পর্যটন মওসুম শুরু হয় এপ্রিল থেকে, চলে জুলাইয়ের শেষ অবধি। এই শহর কেবল তখনই জেগে থাকে। অন্য সময় শীতনিন্দ্রায় চলে যায়। অবকাশ যাপন শেষ করে ধনী অস্থায়ী নাগরিকরা কায়রোসহ অন্যান্য শহরে তাদের মূল আস্তানায় ফিরে যায়। ক্রেতার অভাবে দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, হোটেল সবকিছু বন্ধ রাখতে হয় পরের মওসুমের জন্য। আমাদের কক্সবাজারও পর্যটন অবকাশ শহর। কিন্তু এত খারাপ অবস্থা চিন্তা করা যায়!

হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে পড়েছি। দক্ষিণের রাস্তায় বাঁক নিই। ডোয়া’র সব চেনা এ শহরের। ও অনেকবার এসেছে। শহরের এদিকটা আবাসিক। ল্যামপোস্ট ছাড়া তেমন আলো নেই। অত্যন্ত আয়েশ করে বানানো বাড়িগুলো শূন্য। কারো সাড়া নেই কোথাও। কেমন যেন ছমছম পরিবেশ। আমি নির্জনতার প্রেমে পড়ে যাই। কেমন মায়াবী এ নির্জনতা। কী শান্ত! আলো আঁধারির তুমুল নৈঃশব্দ্য আমাকে গ্রাস করে নেয়।

রাস্তা এখান থেকে ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমে গেছে। সামনে মারশা ক্যান্টনমেন্ট। একটা ফলের দোকান দেখে ঢুকে পড়ি। অনেক হাঁটা হয়েছে। এখন তৃষ্ণার্ত ভীষণ। মিশরে সারা বছর আম চাষ হয়। মরুভূমির বালিতে আঙ্গুর, কমলা, আপেলও হয় প্রচুর। পানির দর। অর্ডার দিই, দু’গ্লাস আছির ম্যাংগা। মানে আমের আসল জুস। শীতকালে ঠাণ্ডা আমের জুস! ভাবা যায়! দোকনি বয়সে তরুণ। ভীষণ স্টাইলিস্ট। রাতের বেলা ঠাণ্ডা আমের জুসের বাঙালি কাস্টমার। মজা পেয়ে যায়। খাতির জমানোর চেষ্টা করে। নাম হাজেম। স্থানীয় কলেজে পড়ে। তার গানের দল আছে। বন্ধুরা মিলে চালায়। আমার ফেসবুক একাউন্ট হাতিয়ে নিয়ে নিমেষেই বন্ধু বানিয়ে ফেলে। কাভার পেইজে কোন এক ব্যান্ড দলের ছবি। আমি অসন্তোষ প্রকাশ করি। হাজেম, তুমি একজন শিল্পী। তুমি একটা ব্যান্ডের সদস্য। তুমি গান করো। তোমার নিজের দলের ছবি কাভার পেইজে কেন নয়! ঐ ব্যান্ডদল কত বিখ্যাত, সে তাদের কত পছন্দ করে ইত্যাদি বলে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। আমি মানতে পারি না। জোর করি। এটা হওয়া উচিত নয়। তোমাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। তুমি নিজে একদিন ওদেরকে ছাপিয়ে যাবে, নিশ্চয়ই। ডোয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

সমুদ্রের পাড়ে বিশাল সুপার সপ। ভেতরে ঢুকে পড়ি। সব চায়না পণ্যে ঠাসা। বাইরে বেরিয়ে দেখি আনন্দের মেলা বসেছে। ছোট্ট এমিউজমেন্ট পার্ক। নানা রকম রাইড। আমাদের সহপাঠীদের প্রায় সবাই এখানে। রাইডে দুলছে। ওদের সাথে দুলতে থাকি। উঠতে থাকি। নামতে থাকি। অনেক উঁচুতে উঠে উত্তরে শান্ত নীল ভূমধ্যসাগর আর দক্ষিণে ঘুমন্ত মারশা মাতরুয়াহ আমার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। মিরার জন্য মন কেমন কেমন করে ওঠে। হ্যালো, মিরা। শোন! আমি এই অদ্ভুত শান্ত শহর মারশা মাতরুয়াহ’র প্রেমে পড়েছি। তুমি এখানে চলে এসো। ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে পাগল-করা নীল জলরাশি দেখতে দেখতে, দু’জনে হাত ধরে ধরে, গ্রিক ল্যামপোস্টগুলো পেরিয়ে পেরিয়ে হেঁটে যাব যতদূর চোখ যায়। আমরা আর কখনো ফিরবো না কোথাও। কোনদিনও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

হ্যানক গাঁয়ের রঙ

কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (তৃতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.