মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Share on social media

এগিলকিয়ার পশ্চিম আকাশ ক্রমশঃ লালচে হয়ে আসছে। দু’চারটে নাম না জানা পাখি লেক নাসেরের উষ্ণ বাতাসে মাছের গন্ধ খুঁজে মরছে। পাঁচ হাজার বছরের পুরানো মন্দিরের অভ্যন্তরে এক অদ্ভুত বৃদ্ধ আমাদেরকে সম্মোহিত করে রেখেছে। সালতানাত অব ওমানের ফাতমা আলাব্রি, ইকুয়েডরের জেসিকা মেরেসি কিংবা আমি; তার সামনে থেকে উঠে পড়ার শক্তি নেই কারোরই।

বৃদ্ধ বলে চলে, ‘দিন পেরিয়ে যায়। মিশরের আকাশে নক্ষত্রের দেখা নেই। সূর্য উদিত হয় না। মধ্য দুপুরে সন্ধ্যার প্রগাঢ় ছায়া। মিশর থেকে সে কি মুখ ফিরিয়ে নিল? ঈশ্বররা এই কিংশিপ থেকে আশীর্বাদ প্রত্যাহার করে নিল নাকি? তাই তো! এত বড় পাপ তারা কেন মেনে নেবে!

‘আমি আবিদোসের গোপন গুহার মুখে বসে আপন কৃতকর্মের হিসাব করছি। হঠাৎ একপাল ঘোড়ার তীব্র হ্রেস্রা ধ্বনিতে মরুর নিঃস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। ধারালো মেইস উঁচিয়ে সেথ দাঁড়িয়ে গুহার মুখে। সঙ্গে তার বিশ্বস্ত অনুচর বাহিনী। হুঙ্কার দিয়ে ওঠে সে।  নে ম ক হা রা ম…!

‘আমি মুহূর্তেই ভষ্ম হয়ে যাই। আবিদোসের মরুর কর্কষ বালুরাশির নিচে সেঁধিয়ে যাই। আর রক্ষা নেই। আর রক্ষা নেই। কিভাবে খুঁজে পেল সে আমাদের অস্তিত্ব! কে তাদের পথ করে দিল প্রাসাদের এত দূর অবধি!

‘চিরনিদ্রায় শায়িত পুণ্যাত্মা ওজাইরিসের দেহ কফিন থেকে টেনে বের করে আনে সেথ। ধারালো মেইসের নির্মম আঘাতে ৪২ খণ্ডে বিভক্ত করে ফেলে তাকে। তারপর দেহখণ্ডগুলো মিশরের এপ্রান্তে-ওপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে সহযোগীদের নির্দেশ দেয়। ওজাইরিসের অস্তিত্ব মিশরীয় পুরান থেকে চিরতরে মুছে দিতে চায় সে। মুহূর্তেই ওজাইরিসের পূণ্যদেহখণ্ড নিয়ে বিশ্বস্ত অনুচররা ঘোড়া ছুটিয়ে মরুর অজানা পথে হারিয়ে যায়।

‘গভীর অন্ধকারে ঢাকা মিশরের আকাশ। নক্ষত্ররাজিও শোকে মুহ্যমান। আইসিসের করুণ আর্তনাদে ঈগলদের সব ডাকাডাকি থেমে যায়। তার হাহাকার-ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আবিদোসের পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আইসিসের আকুল অশ্রুবানে ফেঁপে ওঠে নীলের জলস্রোত। উপচে যেতে থাকে উঁচু দু’কূল। প্লাবন নামে তীরবর্তী জনপথে জনপদে। ভেসে যেতে থাকে সকল পাপ। শীতল হতে থাকে বিস্তৃর্ণ মরুর তপ্ত বালুরাশি। নরম পলিতে ঢাকা পড়ে রুক্ষ যবের ক্ষেত।

‘আইসিস-নেপথিস দু’বোন আবার বেরিয়ে পড়ে মিশরের পথে পথে। খুঁজতে থাকে ওজাইরিসের দেহখণ্ড। সেথ সারা মিশর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিল খণ্ডগুলো। ঐশ্বরিক মায়াবলে দু’বোন একে একে উদ্ধার করে সেগুলো। একত্রিত করে এই মন্দিরের মূল প্রার্থনাকক্ষে। অতি গোপনে। মায়াবলে নিখুঁতভাবে জোড়া লাগায় সবগুলো। তারপর আবার সেই প্রার্থনা। কখনো চোখের জলে ভেসে। কখনো দু’চোখে অগ্নি বর্ষিত হতে থাকে। কখনো উচ্চস্বরে। কখনো একাগ্রে। নিঃশব্দে।

‘রাত যায়। আবার রাত। নিথর ওজাইরিস মন্দিরের মেঝেয় শুভ্র বসনে শায়িত। জেগে ওঠো ওজাইরিস! প্রিয়তম ভাই আমার। পিতা ঈশ্বর গেবে’র বর পেয়েছি। আমার গর্ভে হোরাস আসছে। রক্ষাকর্তা হোরাস। ওহ্ স্বামী, তোমাকে জেগে উঠতেই হবে। মিশরীয় কিংশিপ রক্ষা করতেই হবে। বীর্যবান হও, ওজাইরিস, প্রিয়তম। ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমাকে। গর্ভবতী করো!

‘সপ্তদশ দিবস গত হয়েছে। ওজাইরিস জেগে ওঠে না। আর কী আশা, আর কী স্বপ্ন! এতদিনে সব শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়। হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে সে। ছুটতে থাকে গুহাভ্যরন্তময়। উন্মাদ, উন্মত্ত আইসিস। ওজাইরিসের দেহের শুভ্র বসন হেঁচকা টানে ছিটকে ফেলে দূরে। দেহখণ্ড সমৃণভাবে জোড়া লেগে গেছে! শান্ত ওজাইরিস, অখণ্ড ওজাইরিস নিথর ঘুমে মগ্ন। এখনি জেগে উঠবে যেন। কিন্তু ওর শিশ্ন কোথায়! ওজাইরিসের দেহে শিশ্ন নেই! হোরাসের ভ্রুণ সৃষ্টির জন্য তো ওজাইরিসের বীর্যবান শিশ্ন চাই!’

আমি হা করে এই প্রাচীন বৃদ্ধের ঐশ্বরিক কাহিনী শুনে চলেছি। এ কেমন কাহিনী? ওজাইরিসের খণ্ডিত দেহ ঐশ্বরিক মায়ায় পূর্ণ হয়ে যেতে পারে, অথচ সামান্য শিশ্ন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে কি করে! এ কেমন মায়ার খেলা? দেবী আইসিসের অসীম কষ্টভরা মুখ আমার সামনে ভাসে। তার কষ্ট আমাকে ক্রমশঃ আক্রান্ত করে চলে।

‘ওজাইরিসের বিচ্ছিন্ন শিশ্ন নীলনদের গভীরে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেথের বিশ্বস্ত অনুচরেরা। সেগুলো সংগ্রহকালে শিশ্নের অনুপস্থিতি আইসিসের অগোচরে থেকে যায়। ততদিনে নদের মাছেরা শিশ্ন ভক্ষণ করে ফেলেছে। হতে পারে এও এক মায়ার খেলা! এরপর স্বর্গের ঈশ্বরদের নির্দেশনা আসে। স্বর্ণতন্তু দিয়ে ওজাইরিসের শিশ্ন বুনন করতে হবে আইসিসকে। অসীম মায়াবলে আইসিস স্বর্ণশিশ্ন বুনন করে। পরম মমতায়। অষ্টাদশ দিবসের প্রথম প্রহরে সেই স্বর্ণশিশ্ন ওজাইরিসের ঔরসে প্রতিস্থাপন করে সে। তারপর আবার সেই প্রার্থনা। আর্তনাদ। হাহাকার।’

দেবতা ওজাইরিসকে কফিন-বদ্ধ করে নীলনদে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে প্রাচীনকাল থেকেই নীলনদের জল পবিত্র জ্ঞান করা হয়। আজও অনেক মিশরীয়র বিশ্বাস, নীল নদে সলিল সমাধি মানেই নিশ্চিত স্বর্গ লাভ। কেউ নীলের জলে ডুবে মরলে তার সকল পাপ ধুয়ে মুছে যায়। আত্মা পবিত্র রূপ লাভ করে। কিন্তু ওজাইরিসের শিশ্ন ভক্ষণের অপরাধে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত। ‍সুতরাং নীলনদের মাছ না-খাওয়া আজও গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্যাবু।

‘আমি আবিদোসের পূর্বপ্রান্তে বেদুইন পল্লী হতে উষ্টদুগ্ধ সংগ্রহ শেষে গোপন পথে মন্দিরে ফিরছিলাম। দিবসের শেষ ভাগ হবে হয়তো। পশ্চিমাকাশে আবছায়া গাঢ়তর হচ্ছে ক্রমশঃ। আজ অষ্টাদশ দিবস সূর্যের দেখা নেই। মিশরের অসীম আকাশ জুড়ে সূর্যদেব আবার কী দেখা দেবে!

‘অকষ্মাৎ পশ্চিমাকাশের নিম্নদিগন্তে একটি নক্ষত্রের তীব্র ঝলকানিতে দু’চোখ ঝালাপালা হয়ে যায়। পরপর দু’বার। আলোর বন্যায় ভেসে যায় গোটা মিশর। আমি ঝড়ের বেগে মন্দিরে ফিরে আসি। গুহাভ্যন্তরে তখন ঘটে চলে মহাবিস্ময়। নক্ষত্রের অলৌকিক আলোকচ্ছটায় ওজাইরিসের শিশ্ন তীব্রভাবে উত্থিত হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্করভাবে। ভীষণভাবে। এবং অনিবার্যভাবে আইসিস অতি আকাঙ্ক্ষিত ওজাইরিসকে প্রবলভাবে দেহাভ্যন্তরে গ্রথিত করে নেয়।

চার পর্বে সমাপ্ত ই-বুক

অপর তিনটি পর্ব পড়ুন:

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশশপ্ত (প্রথম পর্ব)

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Favorite Blog

হ্যানক গাঁয়ের রঙ

কোরিয়ান স্লো-সিটি জিয়নজু’র ‘হ্যানক ভিলেজ’ ভ্রমণের গল্প। এখানে আয়োজন করে সকল আধুনিকতা বর্জন করা হয়েছে। এই জনপদে প্রবেশের পর আপনি নিজেকে হঠাৎ কয়েকশ’ বছর পেছনে আবিষ্কার করবেন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (চতুর্থ পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

Related Blog

সেই থেকে নীলের মাছেরা অভিশপ্ত (প্রথম পর্ব)

মিশরীয় পুরানের শক্তিশালী চরিত্র আইসিস ও ওজাইরিসের করুণ প্রেমের গল্পগাথা; লেখা হয়েছে আসোয়ানের ফিলাই টেম্পলে বসে। ইজিপ্টোলজির মূল দর্শন জানতে পড়ুন।

মারশা মাতরুয়াহ’র নির্জনতায় প্রেম

ভূমধ্যসাগরের তীরে মিশরের শান্ত সিগ্ধ অনন্যসুন্দর মারশা মাতরুয়াহ ভ্রমণের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিক্ষেত্র, মরুভূমির এগ্রিকালচার আর মাতরুয়াহ’র সান্ধ্য-জীবন। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি পাবার প্রয়োজন কি!

Micro Video

Visual Storyteller

Rural Development Specialist

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people. Engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.

Bangladeshi photographer, passionate to be Visual Storyteller with special interest in people, engaged in Government Service in the field of Rural Development & Poverty Reduction.